ঢাকা, সোমবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

হাড্ডিসার নদীর মতোই ওদেরও জীবন

শাহজাহান মোল্লা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:২০, মার্চ ২২, ২০১৪
হাড্ডিসার নদীর মতোই ওদেরও জীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: এক নদীই বদলে দিয়েছে একটি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা। কেড়ে নিয়েছে একটি সম্প্রদায়ে জীবনাচার।

রাজধানীর অদূরে সাভারের তেঁতুলঝরা ইউনিয়নের পানপাড়া গ্রামের জেলাপাড়ার চিত্র এটি।

এই গ্রামে রাজবংশী নামে একটি সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন। তাদের পূর্ব পুরুষের একমাত্র পেশা ছিলো মাছ ধরা। ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামটির ৯০ ভাগ মানুষের জীবিকা মাছ ধরা ও বিক্রি করা।  
 
ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে কয়েকটি ডাইং ও নিটিং শিল্পই ধ্বংস করে দিয়েছে নদীটিকে। মরা এ নদীতে এখন আর কোনো মাছতো নেইই- নেই ব্যবহার উপযোগী পানি। আর এ কারণে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে বসবাসকারী রাজবংশী সম্প্রদায়ের জীবিকার চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন অনেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করে, কেউবা আবার রিক্সা চালিয়ে জীবণ-যাপন করছেন।
 
২২ মার্চ বিশ্ব পানিদিবস। এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পানিই শক্তি। ’ রাজধানীর চারপাশে রয়েছে অসংখ্য নদী। ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষিত হয়েছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদীর পানি। রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে সরকারকে যেতে হচ্ছে ৩২ কিলোমিটার দূরে পদ্মানদীতে। মৃত প্রায় নদীগুলোর দিকে নজর নেই কারোরই।   

River_1 
বৃহস্পতিবার বেসরকারি সংস্থা এনজিও ফোরামের সহযোগিতায় তেঁতুলঝরা ইউনিয়নের পানপাড়া গ্রাম সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে। পানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে কয়েকটি নিটিং অ্যান্ড ডাইং কোম্পানি। এগুলোর অশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি গিয়ে মিশছে ধলেশ্বরী নদীতে। বিষাক্ত এই পানি নদীতে মিশে নদীর মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর বিনাশ ঘটিয়েছে। এ-কারণে রাজবংশী সম্প্রদায়ের আদি পেশা মাছধরা এখন বিলুপ্ত। এ সম্প্রদায়ের লোকরা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
 
ধলেশ্বরী নদীর দুই তীরে দুই পুরুষ ধরে বসবাস করা কুলদা রাজবংশী (৭০) বাংলানিউজকে বলেন, আমার স্বামী বলাই রাজবংশী এই নদীতে মাছ ধরেই তিন ছেলে ও দুই মেয়ের সংসার চালাতেন।

নদী মরে যাওয়ায় এখন আর মাছ নেই। আমাদের জীবনও পাল্টে গেছে। এখন দুই বেলা ঠিকমতো খেতেও পারি না। ছেলে রামপদ রাজবংশী রাজমিস্ত্রির কাজ করে ও অন্য পুত্র টোকন রাজবংশী রিক্সা চালিয়ে কোনো মতে দিন পার করে।

নিজের ভিটেমাটি যতটুক ছিলো তা-ও সব সরকার দলীয় নেতারা দখল করে নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে গেলেই জীবননাশের হুমকি আসে। এসব কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বয়স্ক এই নারী।
 
ধীরেন্দ্র রাজবংশী (৫০) বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখানে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক এই নদীর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন আর সেই সুযোগ নেই। মাছ নেই, আমাদের জীবীকাও নেই। কর্ম না থাকায় আমরা এখন বিভিন্ন পেশায় ঢুকে পড়েছি।

এই নদীপাড়ের  কয়েকটি কারখানাই ধ্বংস করে দিয়েছে আমাদের বংশী সম্প্রদায়কে। এ নদীতে আমরা আগে গোসল- করতাম। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতাম। এখন নদীর পানি দিয়ে কোনো কাজই করা যায় না। হাত-মুখ ধোওযার কাজ করলেও খুঁজলি পাঁচড়ায় আক্রান্ত হই। তাই ভয়ে কেউ নদীর পানি ব্যবহার করে না।
 
এনজিও ফোরামের প্রকৌশলী নাজমুল আহসান জানান, ‘এনজিও ফোরাম ও বুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে বছরে গড়ে ১০ ফিট করে পানির স্তর নামতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে। এতে করে আগামী দুই থেকে পাঁচ বছর পর সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেবে এই ইউনিয়নে। ’
 
নাজমুল জানান, সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়ের উদ্যোগেই এই সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি এই গ্রামে। স্থানীয় প্রশাসনও অনেকটা নিশ্চুপ।
River_2 
এ ব্যাপারে কথা হয় সংস্থাটির হেড অফ অ্যাডভোকেসি ও পানি বিশেষজ্ঞ যোসেফ হালদারের সঙ্গে।
 যোসেফ হালদার বলেন, ‘শুধুমাত্র তেঁতুলঝরা ইউনিয়নই নয়, পুরো রাজধানীর একই দশা। সরকার সরাসরি বলছে না, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ বা বালু নদী মৃত। এগুলো আর ব্যবহারের উপযোগী নয়।

কিন্তু পরোক্ষভাবে সরকার বলে দিচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানি পরিশোধন যোগ্য নয়, তাই পদ্মার পানি দিয়ে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে। সরকার রয়েছে নিশ্চুপ। কলকারখানার দুষিত বর্জ্য নদীকে এতোটাই হাল করেছে যে, এসব নদী আর পরিশোধনযোগ্য নয়। ’
 
যোসেফ হালদার বলেন, ‘এছাড়া আমাদের পানি ব্যবহারের প্রতিও সচেতনতা নেই। প্রতি বছর সেচ মৌসুমে কৃষক যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করছে তার মাত্র ৬৫ থেকে ৬৮ ভাগ পানি হলেই যথেষ্ট। কিন্তু শুধুমাত্র সচেতনতা ও সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ৩২ থেকে ৩৫ ভাগ পানির অপচয় হচ্ছে।

আর এই বাড়তি পানি তুলতে খরচ হচ্ছে অতিরিক্ত জ্বালানি। বলা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি হতে পারে সুপেয় পানির জন্য। আর এখনই আমাদের পানির ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তেতুলঝরা ইউনিয়নের মানুষের সুপেয় পানির অন্যতম উৎস ছিলো ধলেশ্বরী নদীটি।

কিন্তু এখন নদী মরে যাওয়ায় শুকনা মৌসুমে এই ইউনিয়নের টিউবওয়েলগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। দ্রুত ধলেশ্বরী নদী রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলে এই গ্রামের পানির সংকট মারাত্মক আকারে দেখা দেবে। ’
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, ডাইং কোম্পানিগুলো কোনো ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) ব্যবহার না করেই কারখানার তরল বর্জ্য নদীতে ফেলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কেউ এখানে কোনো দিন অভিযানেও আসেনি। তাই নির্ভয়ে রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছে কারখানাটি।
 
অনেকগুলো গণমাধ্যমের লোক পেয়ে বংশী সম্প্রদায়ের সব লোক নিজেদের অতীতের সুখের কথা বলছিলেন, আর আকুতি করছিলেন যেন ভালো করে লেখা হয় এ বিষয়ে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।