ঢাকা: ‘একদিন আমাকে আর ওর মাকে রুমে ঢুকতে বারণ করলো। পরে সন্ধ্যায় ওর রুমে ঢুকতে বলে।
দেওয়ালে ফ্রেমে টানানো ছবিগুলোর বর্ণনা দেন ষাটোর্ধ্ব হাসানুর রহমান। এগুলো সবগুলোই সাব্বিরের ক্যামেরা বন্দি। একটা ছবিতে একজন শ্রমিক দাঁড়িয়ে আছেন; বর্ণিল ফ্রেম।
‘কেরানীগঞ্জের জাহাজ মেরামতের ওয়ার্কশপের ওখানে তুলেছিল ছবিটা। এ রকম আরেকটা ছবি আছে, সেটা লন্ডনে ফেস্টিভ্যালে নির্বাচিত হয়েছিল। ওই ছবিটা ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ও একদিন এসে বললো, বাবা এই ছবিটা ইউনিভার্সিটির ক্যালেন্ডারে দিয়েছে। ’
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, এমন একটা ছবি দেখিয়ে হাসানুর বলেন, ‘একদিন আকাশে বিদুৎ চমকিয়ে বৃষ্টি আসে। দৌড়ে ছাদে যায়, এটা ক্যামেরায় তুলে আনে। ’
সাব্বিরের রুমের এক পাশে কম্পিউটারের সামনে বসেন বাবা। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ইউনিভার্সিটি থেকে আসলেই এখানে বসতো সাব্বির। কোনোদিন একটা সিগারেটও খায়নি। আমার ছেলে অনেক ভালো ছিল। খারাপ কথা বলেনি। ওই আলমারিতে ওর ক্যামেরার অনেক লেন্স!’
সাদা ফতুয়ায় মলিন হয়ে আছে সন্তানহারা হাসানুর রহমানের মুখ। ছোটরুমে পায়চারি করেন তিনি। চশমার ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ে চোখের জল।
এক ছেলে, এক মেয়ের বাবা হাসানুর রহমান। সাব্বিরের সঙ্গে বাবার শেষ কথা হয়, সোমবার দুপুর সোয়া একটায়।
‘সাব্বির ফোনে বলেছিল, বাবা পৌঁছেছি। আমরা ভাবি, এখন তাহলে হোটেলে যাবে। আবার যখন দুইটায় ফোন দেই, তখন কেউ রিসিভ করে না। ভাবলাম ফোন রেখে সমুদ্রে গেছে। সোয়া ২টার দিকে ফোন আসে। কোস্টগার্ডের একজন ফোনে বলেন, আপনার সন্তান মিসিং হয়েছে। তারপর বার বার ফোন দেই। কিন্তু, কেউ রিসিভ করে না। ’
আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠেন হাসানুর রহমান। সন্তানহারার বাবার মুখ থেকে কথা ঝরতে থাকে। টেবিলের পেনড্রাইভগুলো দেখিয়ে বলেন, ‘যেদিন যায়, বলে- বাবা আমার একটা পেনড্রাইভ নিয়ে গেটে দাড়াঁও। এখন আর উপরে উঠতে পারবো না। আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। ও হাত থেকে পেনড্রাইভটা নেয়। ছেলের পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ’
বাবা বলেন, ‘আমার ছেলে অনেক ভালো ছবি তুলতো। কয়েক বছর ধরে ওয়েডিংয়ের ছবি তুলেও ভালো আয় করতো। গত শুক্রবারেও একটা ওয়েডিংয়ের ছবি তোলে। ২৫ হাজার টাকা পায়। নিজের আয়ের টাকা দিয়েই লেন্সগুলো কিনেছে। একবার একটা মোবাইল কিনে আনলো আমার জন্য। সেটটা সুন্দর ছিল। ৫ হাজার ৯০০ টাকা ছিল দাম। ’

সন্তানহারা বাবার কথা যেন শেষই হতে চায় না!
এডিশনাল সেক্রেটারি হিসেবে চাকরিজীবন শেষ করেন হাসানুর রহমান।
‘ছেলেকে বলি, চাকরি করবি না! সে বলতো, চাকরি করলে আমাকে কয়জন চিনবে। আমি যে ছবি তুলি, বিদেশে পাঠাই, অনেক মানুষ আমাকে চেনে। ’
‘বুধবার সকালে কোস্টগার্ড থেকে ফোন দিয়ে নতুন দুটি লাশ পাওয়ার কথা বলা হয়। কোস্টগার্ড জানায়, সাব্বিরের লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু, পরে ওর বন্ধুরা ইন্টারনেটে দিলে দেখি ওটা সাব্বিরের নয়। এখন ছেলের লাশের জন্য অপেক্ষা করছি!’
অাবার ড্রইংরুমে ফিরে আসেন হাসানুর রহমান। ‘এখন আমি আর কী করবো! চাকরি শেষে অনেকে বলছিল, কনসালট্যান্সি করার কথা। কিন্তু যাইনি। আমার সন্তানের জন্যইতো সব ছিল। ’
বলেন, ‘গাড়ি খুব প্রিয় ছিল সাব্বিরের। ওর বিছানায় কয়েকটি খেলনা গাড়ি থাকতো। ঘুমানোর আগে সেগুলো হাত দিয়ে চালাতো ও। ’
নিজের ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেন এ বাবা। ‘ইন্টারমিডিয়েটে কারো কাছে কোচিং করেনি, কিন্তু ঠিকই জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু, বুয়েটে হলো না। তবে চুয়েট আর কুয়েটে হলো। আমি ভাবলাম, একটা মাত্র ছেলে সে যদি ঢাকার বাইরে থাকে, যদি আবার অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে! তাই, যেতে দিইনি। আহসানউল্লায় ভর্তি করালাম। ’
ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন মা সেলিনা রহমান। আর বাসা ভর্তি আত্মীয়-স্বজন সান্ত্বনা দিচ্ছেন বড়বোন ডা. নাদিয়া হাসানকে। কান্না থামতে চায় না বড় বোনের।
সরকারি চাকরির দীর্ঘজীবনের ২৮ বছর আজিমপুর কলোনিতে কাটিয়েছেন হাসানুর রহমান। বলেন, ‘একবার ঈদের আগে স্যান্ডেল কিনতে যাই ওর জন্য। ও তখন ছোট। যেই স্যান্ডেলটার পাশে ঘুর ঘুর করছিল, ওটার দাম ১২০০ টাকা। ও বুঝতে পারে, তখন আমার সেটা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। পরে ৬০০ টাকার স্যান্ডেল কিনে দেই। ওর মাকে বলি, পরের বার কিনে দেবো। ’
কুষ্টিয়ার হাসানুর রহমান এখন অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন ব্যক্তি জীবনে। এক সময়ের দাপুটে আমলা এখন নিয়তির নিষ্ঠুরতায় অসহায়।
এপ্রিলের ১৪ তারিখ সাব্বিরের জন্মদিন। এবারের জন্মদিন বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে সন্তান। এ রকম এক জন্ম দিনেই সন্তানকে ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন বাবা।
বলতে থাকেন হাসানুর রহমান, ‘উদয়কে বাঁচাতে গিয়েই হয়ত মারা পড়েছে সাব্বির। ওর বন্ধুরা বলেছে, সাব্বির তীরে উঠে আসে। কিন্তু, পরে যখন দেখে উদয় তলিয়ে যাচ্ছে, বাঁচাতে যায় সে। এবার ভাটায় টেনে নেয় দুজনকেই।
ওর মধ্যে লিডারশিপের গুণাগুণ ছিল। বন্ধুদের মধ্যে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারতো সে। ’
বাবার কাছে সন্তান তো এমনই। অনুরোধ করলেন, ‘আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। কিন্তু, ডেঞ্জার জোনে যেন কেউ যেতে না পারে বা এ ব্যাপারে সতর্কতা সংকেত দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। ’
গত সোমবার সেন্টমার্টিনসে বেড়াতে গিয়ে আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নামেন। এ সময় তাদের মধ্যে নয়জন গভীর পানি ও স্রোতের মধ্যে পড়ে যান। দ্রুত তাদের মধ্যে পাঁচজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকি চারজন নিখোঁজ থাকেন।
টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে মানফেজুল ইসলাম ও সাদ্দাম হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। ঘটনার তৃতীয় দিনে বুধবার সকালে উদ্ধার করা হয় দুইজনের মরদেহ।
শেষতথ্য পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি সাব্বির ও উদয়ের মরদেহ উদ্ধারের খবর।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৪
** আমার সোনার ধন বাপ্পীকে এনে দাও
** উদয়ের ফেরার অপেক্ষায় বাবা-মা
** শিক্ষা সফর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিদের্শনা জারি হচ্ছে