ঢাকা, রবিবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-১

বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন!

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:২৮, এপ্রিল ৩০, ২০১৪
বাগানে এখনো ব্রিটিশ শাসন! ছবি: নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: ব্রিটিশরা বাংলা ছেড়েছে ৬৬ বছর আগে। প্রায় দুশো বছর পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, নিপীড়ন এখনো প্রবাদপ্রতিম।

উপনিবেশ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার সব নমুনা দেখিয়ে গেছে সাদা চামড়ার মানুষগুলো।

এক সময় বাংলায় রেললাইন ছিল না। ছিল জঙ্গল, পাহাড়। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট এলাকায়। ব্রিটিশরা দেখলো এই জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরির চেয়ে রেললাইন বসানো বেশি সহজ। যোগাযোগও সহজ হবে। করলো সেটাই। পাহাড়, টিলার লালমাটি দেখে চকচক করে উঠলো তাদের চোখ। বুদ্ধি আঁটলো এই মাটি কাজে লাগানোর। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাজার, রেলস্টেশনের মানুষদের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্রি পান করানো শুরু করলো শরীর মন সতেজকারী পানীয় চা। মানুষকে বোঝালো এটা কোনো নেশা নয়।

তারপর উড়িষ্যা, আসামের শ্রমিক ও সহজ-সরল স্থানীয় স্বল্পসংখ্যক বাঙালি নিয়ে গড়ে তুললো চা বাগান। সিলেটের মালনিছড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথমটি। সেটা ১৮৫৪ সালের কথা। তারপর মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিতাড়িত হওয়ার পর চাবাগানের কর্তৃত্ব চলে যায় ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের হাতে। তবে চলতে থাকে সেই ব্রিটিশ নিয়ম। একাত্তরে শোষক পকিস্তানীদের বিতাড়নের পর বাঙালিদের কাছে আসে মালিকানা। তবে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানী ম্যানেজারদের মতো কম যায়নি বাঙালি ম্যানেজার-মালিকরাও। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরুলেও চাবাগানে চলছে নিদারুণ শ্রমিক শোষণ। বাগানে এখনো চলে ব্রিটিশ আইন। মেমসাহেব, সাহেব, সর্দার, আর্দালিসহ চলে সব ব্রিটিশ আমলের ভাষা। শ্রমিকরা এখনো প্রতি মুহূর্তে প্রভাবশালী মন্ত্রী, মালিক, ম্যানেজারের পায়ের নিচে। মাথা তুলে কথা বলার শক্তি তাদের নেই।

এখনো তাদের প্রতিদিনের মজুরি মাত্র ৬৯ টাকা। শ্রমঘণ্টা গড়ে ৮ টাকার মতো। নেই স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থা। থাকার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। রেশনের যে সুবিধাটুকু দেওয়া হয় সেটাও হাস্যকর। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার চিত্র ভয়াবহ। মালিকপক্ষের শোষণই যেন শ্রমিকদের একমাত্র প্রাপ্তি!

শোষণ করেই ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ উপমহাদেশের সোনার মাটি থেকে লুটেছিল বিপুল পুঁজি। পাকিস্তানী শোষকদেরও ঘটেছে তাই। বিনিময়ে প্রাপ্তির ঘর শূন্য। সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে বর্তমানের মালিকরাও। যেখানে একজন দিনমজুরের ন্যূনতম মজুরিও এখন ২৫০-৩৫০ টাকা সেখানে একজন চা শ্রমিকের মজুরি কীভাবে ৬৯ টাকা হয় তা বোধগম্য নয়। সেটাও হয়তো মেনে নেওয়া যেত যদি শ্রমিকদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা সেগুলো দিত। শহরের উপর ছাড়া একটু দূরের বা ভিতরের চা-বাগানগুলোর শ্রমিকদের দুর্দশা আরও বেশি।

বর্তমানে বাংলাদেশে চা-বাগান রয়েছে মোট ১৬৩টি। তবে মূল চা-বাগানের সাথে ফাঁড়ি বাগানগুলো হিসেবে করলে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬০টিতে। ২০০৮ সালে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ৩২ টাকা ৫০ পয়সা (আধা মার্কিন ডলারেরও কম)। এরপর ২০০৯ সালে ৩০ আগস্ট বাংলাদেশীয় চা সংসদ এবং বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দুই বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সম্পাদন করে। সে মোতাবেক ‘এ’ ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের জন্য ৪৮ টাকা, ‘বি’ ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের জন্য ৪৬ টাকা এবং ‘সি’ ক্লাস বাগানের শ্রমিকদের জন্য ৪৫ টাকা। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নবগঠিত নের্তৃত্ব (২০০৮) মালিকপক্ষের কাছে ২০০৯ সালে যে দাবি নামা পেশ করেছে, তাতে শ্রমিকদের দৈনিক নগদ মজুরি ৩২.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকা করার দাবি করে।

পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাগানে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিগত পাঁচ বছরে ৭ টাকা হারে মোট তিনবার ২১ টাকা  মজুরি বাড়ে। সে মোতাবেক বর্তমান ক্লাস ভিত্তিক চা বাগানের শ্রমিক মজুরি ৬৯ টাকা, ৬৭ টাকা এবং ৬৫ টাকা। যেখানে প্রতি বছর মজুরি বৃদ্ধির কথা ২০ টাকা করে যেখানে চুক্তি না হওয়ার কারণে অর্ন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ৫ বছরে বেড়েছে মাত্র ২১ টাকা। যদিও চা শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের ভাতা, হ্রাসকৃত মূল্যে রেশন, ফসল উৎপাদনের জন্য জমি ব্যবহারের সুযোগ, চিকিৎসা, প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রভৃতি সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে দাবি মালিকপক্ষের। তবে শ্রমিকপক্ষের দাবি তারা এটা পান না প্রয়োজন অনুযায়ী।

শ্রীমঙ্গলের লাখাইছড়া চা-বাগানের শ্রমিক সুখরাম সাঁওতাল এবং নিয়তি ভূমিজ বাংলানিউজকে বলেন, যা পয়সা দেয় তা দিয়ে কিছুই হয় না আমাদের। পরিবার নিয়ে অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়।

মজুরি বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বাংলানিউজকে বলেন, এর কারণ হলো বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের বিরাজমান দ্বন্দ্ব। চা-শ্রমিক ইউনিয়ন তো শ্রমিকদের স্বার্থের একটি ‘বারগেনিং এজেন্ট’। তারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করে শ্রমিকদের মজুরিসহ নানা স্বার্থ আদায় করে থাকে। যেখানে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো প্রতিনিধি নেই, সেখানে তো শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। যে কোনো মূল্যেই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নকে সুসংগঠিত হয়ে শ্রমিকদের স্বার্থের দিকগুলো নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

বিজয় হাজরা আরও বলেন, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার ফলেই এই সমস্যাটি চরম আকার ধারণ করেছে। বাগান মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে যাচ্ছে। চা-শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ৬৯ টাকা একেবারেই কম। শ্রমিকরা কোনো অবস্থাতেই এই নিম্নমানের টাকায় খেয়ে-বাঁচতে পারছে না।

শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘টি সেল’ বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, চা শ্রমিকরা ‘ইনক্যাশ’ পাচ্ছে ৬৯ টাকা। কিন্তু এর পাশাপাশি তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন। যেমন- একেবারে স্বল্পমূল্যে সাপ্তাহিক রেশন,  ফ্রি বাসস্থান, ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ফ্রি লেখাপড়া, ফ্রি চিকিৎসা, প্রয়োজনবোধে উন্নত চিকিৎসার জন্য চা-শ্রমিকদের বাগানের বাইরের উন্নত হাসপাতালে প্রেরণ, কাজের যন্ত্রপাতির ফ্রি জোগান, ফসলি জমির ফ্রি ব্যবহার, বিভিন্ন ফল-ফসল উৎপাদন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা এগুলো হিসেব করলে এদের মজুরি দৈনিক ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় গিয়ে পৌঁছুবে।

শাহজাহান আকন্দ আরও বলেন, আমরা রেশন (আটা) ১৪ থেকে ১৬ টাকায় কিনে কেজি প্রতি ১ টাকা ৩০ পয়সায় চা শ্রমিকদের কাছে বিক্রি করছি। এছাড়াও একজন চা-শ্রমিক নির্দিষ্ট পরিমাণ (কোনো চা বাগানে ২২ কেজি কিংবা তারও বেশি) চা-পাতা উত্তোলনের পর আরও অতিরিক্ত পাতা উত্তোলন করলে ওই অতিরিক্ত মজুরিও চা শ্রমিকরা পেয়ে থাকে।

বিজয় হাজরা এ ব্যাপারে বলেন, প্রতি কেয়ার জমিতে বছরে চা-শ্রমিকদের কাছ থেকে সাড়ে তিন মন আটা বা রেশন কাটা হয়। যা সরকারি খাজনা থেকেও অনেকগুণ বেশি।  

কিন্তু বাস্তবে শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া, কালীঘাট প্রভৃতি চা-বাগান ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে পরিমাণ আটা তারা পান তাতে সপ্তাহ যায় না। আর এর আটার মধ্যে অর্ধেকই থাকে ভূষি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জামও তারা পান না। আর রোগ অসুখ হলে কাজ করতে বাগানে যেতে পারেন না বলে চিকিৎসার নামে ভোগ করতে হয় আরেক শাস্তি।


ব্রিটিশ শাসনের আরেক নমুনা পড়ুন আগামীকাল: চা-শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা-২
‘অসুস্থ হওয়া অপরাধ, নেই নারী ডাক্তার’

বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।