কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার: ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলে ফেরানোর কার্যক্রম পদে পদে বাধার মুখে পড়ছে। বাস্তবায়নকারীদের সামনে উঠে আসছে বহুমুখি চ্যালেঞ্জ।
অভিভাবকসহ স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন বলছেন, দারিদ্র্য যেসব শিশুকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, যেসব শিশুর পরিবারকে তিনবেলা খাবার যোগাড়ে হিমশিম খেতে হয়, যে-সমাজ লেখাপড়ায় ততটা আগ্রহী নয়, সেখানে শিশুদের স্কুলে ফেরানোটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া মাঠের তথ্য না নিয়ে উপর থেকে পরিকল্পনা নেওয়া হয় বলে কর্মসূচি বাস্তবায়নেও নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পাড়াসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলমুখি করার কার্যক্রম সরেজমিন দেখে এক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে বাংলানিউজ। ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলে ফেরানোর কার্যক্রম প্রত্যন্ত পল্লীতে আলো ছড়ালেও রয়েছে অনেক সমস্যা। এইসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে কার্যক্রম আরও ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলে ফেরাতে পরিবারের আর্থিক সংকট, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, পরিবারে উপার্জনের লোক না থাকা, দক্ষ শিক্ষক না পাওয়া, লেখাপড়ার মান ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পাড়ায় বেসরকারি সংস্থা ‘কোডেক’ পরিচালিত বেশ কয়েকটি ‘শিখন স্কুল’ রয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় ‘সাপোর্টিং দ্য হার্ডেস্ট টু রিচ থ্রু বেসিক এডুকেশন-শেয়ার’ এর আওতায় এ কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও এই পাড়ায় হেলপ স্কুল, মুক্তি স্কুল, ব্র্যাক স্কুলসহ কয়েকটি শিশু শিক্ষার প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে।
পরিবারে আর্থিক সংকট
ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলমুখি করতে একটি বড় বাধা হচ্ছে পরিবারের আর্থিক সংকট। দরিদ্র পরিবারের মা-বাবার স্বাভাবিক ধারণা, স্কুলে যাওয়ার চেয়ে কাজে

কক্সবাজারের দ্বীপ কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের কিরণপাড়া গ্রামের একটি গল্প। সমুদ্রগামী জেলে নূর মোহাম্মদের বড় ছেলে মেহেদী হাসান তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। সংসারের খরচ চালাতে বাবাকে সাহায্য করছে। বাবার রোজগারে বড় অংকের দেনা শোধ করছে, আর মেহেদি টেম্পুর হেলপারের কাজ করে সংসারের দৈনন্দিন খরচ চালাচ্ছে। মেহেদীর বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে রাজি করা সম্ভব হয়নি।
অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব
শিশুদের স্কুলে নিতে অভিভাবকদের অসচেতনতা অনেকাংশে দায়ী। বাবা-মায়ের ভ্রান্ত ধারণা, লেখাপড়ার চেয়ে কাজে গেলেই তা লাভজনক। বাবার কাজে ছেলেকে দক্ষ করে তুলতে বিশেষ করে ছেলেশিশুদের কাজে নিয়ে যান বাবারা। তারা মনে করেন, লেখাপড়ার চেয়ে বরং কাজ শিখতে পারলেই দ্রুত বেশি টাকা রোজগার করতে পারবে। নিজের ভবিষ্যৎটা ভালভাবে গড়তে পারবে।

পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের চর মার্গারেট গ্রামের জেলে সাইফুল ইসলাম তার দুই ছেলেকেই পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার আগেই কাজে নামিয়েছেন। অথচ ক্লাসে ওদের রোল নম্বর ছিল চার-পাঁচের মধ্যে। সাইফুল বাংলানিউজকে বলেন, ছোটবেলা থেকে কাজ করলেই ওরা দ্রুত দক্ষ হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে আর সমস্যায় পড়তে হবে না।
পরিবারে উপার্জনের লোক না থাকা
কুতুবদিয়া পাড়াসহ উপকূলের অনেক পরিবারের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে যাওয়ার অনেক গল্প পাওয়া যায়। বহু পরিবার একাধিকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। হয়তো বাড়িঘর ভেসে গেছে, হারিয়েছে সব সহায় সম্পদ। এমনকি যার রোজগারে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার উঠতো, তিনিও চিরদিনের মত বিদায় নিয়েছেন। এর চাপ পড়েছে পরিবারের বড় সন্তানের ওপর। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বহু শিশু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তাদেরকে পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
দক্ষ শিক্ষক না পাওয়া
ঝরেপড়া শিশুদের স্কুলমুখি করতে স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ শিক্ষক না পাওয়া একটি অন্যতম সমস্যা বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে পরিকল্পনায় ভুলের কথাও বললেন অনেকে। প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘন্টা শিশুদের পড়ানোর বিনিময়ে শিক্ষককে যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া হয়, তা খুবই নগণ্য। বেতনের ক্ষেত্রে আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্কুলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো স্কুলের শিক্ষকেরা ৮ হাজার টাকা, আবার কোনো কোনো স্কুলের শিক্ষকেরা মাত্র ১৬শ’ থেকে দুই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন।

শিশু বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে, স্কুল শেষ করে জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষকদের অন্য কাজে যেতে হয়। ফলে তাদের পক্ষে স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ানোয় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।
লেখাপড়ার মান ধরে রাখা কঠিন
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রধানত তিন কারণে শিশু বিদ্যালয়গুলোর লেখাপড়ার মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণগুলো হচ্ছে: দক্ষ শিক্ষক না পাওয়া, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দেওয়া এবং কম বেতন। বিদ্যালয় পরিচালনা থেকে শুরু করে পাঠদানের কারিকুলাম সবই হয়তো অনুসরণ হচ্ছে, কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখাপড়ার মানে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। মান ঠিক রাখতে এই তিন সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন অভিভাবকেরা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
উপকূল অঞ্চল নানামুখি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লণ্ডভন্ড হয়। ঘরবাড়ি হারায় বহু মানুষ। স্কুলে যাওয়ার উপযোগী বহু শিশু মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারিয়ে ফেলে। এর ফলে তাদের স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের তৈরি করে দেওয়া শিশুস্কুল ঘরগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বসে পড়লে তা পুনর্নির্মাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের শিশুশিক্ষা কার্যক্রম ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবরটি বাংলানিউজে দেখতে চান? মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com
** কুতুবদিয়া পাড়ায় কোডেক, ঝরেপড়া শিশুরা স্কুলের পথে
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৫ ঘন্টা, মে ০৯,২০১৩