ঢাকা, রবিবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৭ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

রহস্যময় প্রাণি

মনিরুজ্জামান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:০৫, মে ১৫, ২০১৪
রহস্যময় প্রাণি

ঢাকা: কোন প্রাণিকে বাঁচাতে চাইলে, তাদের সম্পর্কে জানতে হবে- এ কথাটি পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃত।

বৈশ্বিক তথ্যের এ যুগে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রাণিদের সম্পর্কে যা জানার তা প্রায় সবই আমরা জানি।

এর থেকে বেশি কিছু জানার আর নেই।

কিন্তু এর পরেও নতুন প্রজাতির প্রাণি আবিস্কার হচ্ছে এবং হাজার হাজার প্রাণি অন্ধকারেই রয়ে গেছে যাদের সম্পর্কে খুব কম লোকই শুনেছে এবং খুব কম তথ্যই জানা গেছে। আর এসব প্রাণিদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ আমেরিকার জায়ান্ট আর্মাডিলো।

পাঁচ ফুট লম্বা এ প্রাণিটি‍র সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। এটি একটি রহস্যময় স্তন্যপায়ী প্রাণি। কেন এটি রহস্যময়? কারণ, বিশাল শরীর নিয়েও জায়ান্ট আর্মাডিলো অদৃশ্য থাকার ওস্তাদ।

মূলত নিশাচর, জীবন কালের দুই-তৃতীয়াংশ কাটে ভূমির নিচে, দৃশ্যমান হয় গভীর অন্ধকারে শুধুমাত্র পিঁপড়া ও টারমাইটস খোঁজার সময়। পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান কারী মানুষ কালেভদ্রে তাদের দেখতে পায়। এদের উপস্থিতির একমাত্র চিহ্ন হলো- ভুমিতে বড় ও অযৌক্তিক ধরনের গর্ত।

গত প্রায় ২০ বছর ধরে, আমি দক্ষিণ আমেরিকার বহু জায়গা ঘুরেছি যেসব স্থানে জায়ান্টরা বসবাস করে বলে মনে করা হতো। কিন্তু আমি একটিও দেখতে পাইনি এবং এমন কারো সঙ্গে কথা হয়নি যে তাদের দেখেছে। আমি আমার প্রত্যেক ভ্রমণ গাইডকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু আমার এ প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র শূন্য দৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। দুর্ভাগ্য হলেও আমি অন্তত একটি জায়ান্টকে দেখতে চাই। এমন অবস্থায় সম্প্রতি আমি ইন্টারনেটে একটি জায়ান্ট আর্মাডিলোর ছবি দেখতে পাই যেটা রাতের বেলা ধারণ করা হয়েছিল। বিষয়টি আমাকে ব্যাপকভাবে তাড়িত করেছে।

ব্রাজিলের প্যান্টানাল আর্দ্র ভূমি থেকে ড. আরনাউড ডেসবিয়েজের তোলা ওই ছবিটি ছিল অসাধারণ, যাতে ফুটে উঠেছে এর বিস্ময়কর অপ্রতুলতা, বাইরের খোলা জায়গায় ধারণ করা- বন্য ও ভয় হীন। এই বিষয়টিকে যদি সামনে রাখা হয়, তাহলে বলা যায় কিছু ছবি বাদে জায়ান্ট আর্মিডিলো সম্পর্কে আর কোন তথ্য মানুষের কাছে নেই। অনুসন্ধানের সংখ্যা খুবই কম, কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে তাদের বংশ বৃদ্ধি প্রক্রিয়া, খাদ্য অভ্যাস ও কোনো অঞ্চলে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদান সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায়নি। কেউ এটাও বলতে পারেনা যে, তারা সংখ্যায় কত এবং পৃথিবীর কোন অঞ্চল জুড়ে তাদের বসবাস। যদিও ইতোমধ্যে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, জায়ান্ট আর্মাডিলোরা দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাস করে কিন্তু এ তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ ও অনুমান নির্ভর।

সহজ ভাবে বলা যায়, এ মহাদেশের একটা বড় স্তন্যপায়ী প্রাণি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। ড. ডেসবিয়েজ ও তার সহযোগী পশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডেনিলো খুইবার, জীব বিশেষজ্ঞ গ্যাবরিয়েল ম্যাসোক্যাটো এসব কিছুকে চ্যালেঞ্জ করে কাজে নেমেছেন। এই প্রাণি নিয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার বর্তমানে তৃতীয় বছর চলছে। অবশ্য এটিই জায়ান্টদের সম্পর্কিত প্রথম গবেষণা। এই প্রযেক্টটি ডিয়ো ও রিতা কেলহে লিমা নামে দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত ফার্ম ‘বায়া দাস পেদরাস’কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। ডিয়ো ও রিতা কেলহে লিমা এই প্রযেক্টটির একজন কার্যকরী সমর্থক, যদিও ২০১১ তে প্রযেক্টটি শুরুর আগে কখনো তারা জায়ান্ট আর্মিডিলো দেখেনি।   

গত বছর, ওই টিমে যোগ দেওয়ার জন্য অথবা জায়ান্টদের কিছু ছবি নেওয়ার জন্য আমি ড. ডেসবিয়েজের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কয়েক সপ্তাহের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে জায়ান্টদের ছবি সংগ্রহের জন্য পরিচিত গুহা এলাকায় আমরা কিছু ক্যামেরা স্থাপন করলাম। তারা যেন বিরক্ত বোধ না করে এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হলো। সামান্য একটু শব্দ হলেই তারা দ্রুত গতিতে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ে, ওই রাতে আর বাহিরে বের হয় না।
ক্যামেরা গুলো এমনভাবে স্থাপন করা হলো যাতে জায়ান্টরা স্বভাব মতো আমাদের যন্ত্রপাতির কাছে পৌঁছাতে না পারে, কারণ একবার পৌছাতে পারলেই এটি তা ধূলির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এসব ক্যামেরা যুক্ত স্থানে জায়ন্টের দেখা পাওয়া গেলেও মাত্র একটি ছবির বেশি নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু একদিন রাতে, তারা কয়েক মিনিটের জন্য বাহিরে অবস্থান করলো। এতে গর্তে পুনরায় প্রবেশের আগেই এক ডজন বা তার থেকে বেশি ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব হলো।

শেষ পর্যন্ত আমরা বিস্ময়কর এই প্রাণির উচ্চমানের কিছু ছবি নিতে করতে সক্ষম হলাম যা এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। যদিও, তিন সপ্তাহের পরিশ্রমে আমি একটিমাত্র আর্মাডিলোকে দেখতে পেয়েছিলাম এবং দ্বিতীয়বার সেকেন্ডেরও কিছু কম সময়ের জন্য তাদের সাক্ষাত হয়েছিলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওয়ানা হয়েছিলাম। আমি এতো অবাক ও অপ্রস্তুত হয়েছিলাম যে তার কোনো ছবি নিতে পারিনি।  

এই গবেষণা প্রজেক্টটি এর মধ্যেই অন্ধকার জগতের গোপন এসব প্রাণিদের সম্পর্কে জানতে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। জায়ান্টদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ প্রায় অসম্ভব, কারণ এরা সামান্য বিশৃঙ্খলা সহ্য করতে পারে না। এ জন্য ড. ডেসবিয়েজের টিম বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্যামেরার ফাঁদ পাতলেন। সেই সঙ্গে প্রাণিটির গতিবিধি লক্ষ রাখতে GPS (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ট্যাগিং সিস্টেম ব্যবহার করা হলো। আর এসবের মাধ্যমেই সম্ভব হলো এমন একটি কাজ যা আগে কখনো সম্ভব হয়নি। তা হলো- জায়ান্টের সঙ্গে একটি বাচ্চা জায়ান্টের উপস্থিতির ছবি।

এসব পর্যবেক্ষণের ফলে ঈর্শান্বিত কিছু আবিষ্কার সম্ভব হলো। জানা গেলো, ‘পরিবেশের প্রকৌশলী’ (ecosystem engineers) এদের কিছু স্বাতন্ত্র ভূমিকা। খনকের রাজা জায়ান্ট আর্মাডিলো ভূমিতে সুড়ঙ্গ তৈরি করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তবে এর মধ্যেও রয়েছে দৃড় সংকল্প ও কার্যকারিতা। প্রায় প্রতি রাতেই তারা নতুন গুহা তৈরি করে। এই খনন প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যই প্রয়োজনীয়- কারণ এতে যেসব গর্ত তৈরি হয়, তা ২৪টির ও বেশি প্রজাতির আবাস, আশ্রয় ও বিশ্রামের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

জায়ান্ট আর্মাডিলো প্রজেক্টটি অন্য কয়েকটি শাখায় বিভক্ত- তুলনামুলক ভাবে ছোট এবং এর সম্পর্কযুক্ত প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এসবের মধ্যে রয়েছে-  ছয় ও নয় ডোরা বিশিষ্ট আর্মাডিলো এবং অপর একটি প্রজাতি যার অস্তিত্ব আছে বলে আমি জানি না, সেটা হলো নগ্ন লেজ বিশিষ্ট আর্মাডিলো। সম্মিলিতভাবে এসব গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য স্বল্প পরিসরে জানতে পারা এসব প্রাণিদের বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাঢিক অবলম্বনে।


                                  গর্ত থেকে বেরিয়ে প্রথম কাজ, আশপাশে কোন শত্রু আছে কিনা তা দেখা

                                                     জায়ান্ট আর্মাডিলোর প্রথমবার ধারন করা ছবি

                                          বাচ্চা জায়ান্ট আর্মাডিলোটি গর্ত থেকে বের হওয়ার সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে

                                      রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা তরুণ জায়ান্ট আর্মাডিলো গর্ত থেকে বের হচ্ছে

                                     মাটি কেটে মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই জায়ান্টরা মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে পারে

                                  তারা ভরা রাতে, ড. ডেসবিয়েজ একটা জায়ান্টের অবস্থান বের করার চেষ্টা করছেন

                                      জায়ান্টদের দৃষ্টিশক্তি খুবই দুর্বল, তারা পৃথিবীকে দেখে মূলত গন্ধের মাধ্যমে

                                                        জায়ান্ট আর্মাডিলো একটি উই পোকাকে পর্যবেক্ষণ করছে


বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।