বঙ্গোপসাগর। এখানে ইলিশের বাস।
আমাদের বঙ্গোপসাগরটি অত্যান্ত ক্রূর স্বভাবের। সব সময়ই উত্তাল থাকে এটি। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ ইলিশের যেমন পছন্দ, তেমনি তাদের প্রজননের জন্যেও ওই সাগরের প্রভাব খুব কার্যকর। ফলে বঙ্গোপসাগর ইলিশের বাসভূমি। সে হিসাবে তার কদরও কম নয় বৈশাখ মাসের শেষ থেকে আশ্বিন মাসের প্রথম বছরের ঋণশোধ, মেয়ে বিয়ে, সব কাজের জন্যে আদের মূল প্রস্তুতি শুরু হয় এ সময়েই। কিন্তু এ বছর ইলিশের খবর নেই।
ভোলার বোরহানউদ্দীন থানার চাঁদপুর এলাকা। মেঘনা আর বঙ্গোপসাগর মিলেছে এখানে। বেড়ি বাঁধের ওপর একটু কাত হয়ে তাকালে দু’রঙা জলের সীমারেখা দেখা সম্ভব। আর কাছে গেলে উত্তাল তুফানের ভেতরেও সাগর ও নদীর মিলন মোহনা বোঝা যায়। মেঘনার জল ঘোলাটে। একটা ক্রোধ জলের শরীরে থাকলেও হানাদারি স্বভাবের ছাপ নেই। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ জলরাশির ভেতরে কি নির্মম নিষ্ঠুরতা তা না দেখলে বোঝা বড়ো দায়। একদিকে টওয়ারের সদৃশ তুফানের ক্ষিপ্রতা, অন্যদিকে কূল-কিনারশূন্য গতিহীন এক জীবনের দ্রোহ- যার সবটাই বেঁচে থাকার জন্যে। এ বড়ো কঠিন বাস্তবতা। এক-একটু পর পর হাঙরের নিষ্ঠুরতা নিয়ে তেড়ে আসে কাঁচের টাওয়ারের মতো এক-একটা ঢেউ। আঁছড়ে পড়ে ইলিশধরা ট্রলারের পাশে। জলে ভরে যায় পাটাতন। আর ট্রলারটা ছেঁড়া কাগজের মতো দুলতে থাকে।

জীবন এখানে যেকোন মুহূর্তে মৃত্যুতে পরিণত হতে পারে। অথচ এই ভয়াবহ জীবনদোলার ভেতরেও শহীদ আর তবারক বিড়ি বিনিময় করে। বউয়ের কথা নিযে রসিকতা করে। এই রসিকতার কোনো ব্যাকরণ নেই। তবু জীবনযুদ্ধেরর এক স্বরলিপি বলে মনে হয় একে। রসিকতার ভেতরে খিস্তি-খেউর, যৌনজীবনের গন্ধ মেলে, আবার তার মধ্যে বিম্বিত হয় অসহায় মানুষগুলোর স্বপ্নের প্রতিচ্ছিবি। ফলে এ রসিকতা আর রসিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাদের রসিকতার ভাষা শুনলে একে অশ্লীলতাও মনে হতে পারে। কিন্তু এটা শ্রম-ঘাম, কষ্ট ভুলে থাকার থাকার একটি বিনোদনও বটে, যা নৌকায় নৌকায় চলে। অথচ তারাও জানে একটু বেসামাল হলেই ট্রলার উল্টে নিখোঁজ হবে। তাদের প্লাস্টিকের টায়ার আর বাঁশের ভেলা কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তবুও সাগরের ভয়ের চেয়ে পেটের ক্ষুধার তেজ এতো বেশি যে, ক্ষুধা ভয়কে জয় করতে বাধ্য হয়। রসিকতা জীবনসংগ্রামের একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।
তবারক, শহীদ, সবার হাতেই কমপক্ষে গণ্ডাখানেক তাবিজ কবচ ঝুলছে। কেন ঝুলছে? প্রশ্ন করলে হাসে। এগুলো থাকলে বালা-মসিবত থাকে না। কিন্তু বালা-মসিবত এতে কি কেটেছে? এ প্রশ্নের উত্তর তারা জানে না। কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলে- মুরব্বিরা দিছে তাই, ক্ষ্যাতি তো কারো হবে না, কি কন?
শহীদ, তবারক মেঘের ভাষা বোঝে, ঢেউয়ের ভাষা বোঝে, সময়ের ভাষা বোঝে। যাদের চার পুরুষ জলের ভেতরে জীবন কাঠিয়েছে তারা জানবে না? তারা ‘ট্যাডেস্টার’ রেডিওকে (জেলেরা এটাই বলে) বিশ্বাস করে না। সে সবের বিপদ সংকেতে বিপদ সংকেতে বিপদ থাকে না। সব উল্টাপাল্টা সংবাদ আসে। যেদিন তারা যা বলবে তার উল্টোটা ঘটবেই, সব জেলেদেরই এই বিশ্বাস। কিন্তু সবকিছুর পরেও জেলেদের সুখ নেই। চাঁদপুর অঞ্চলের জেলে পাড়ায় আর আঁশটে গন্ধ ভাসে না। দাউ দাউ জ্বলে ক্ষুধা চারদিকে। অস্বাস্থ্য-অজীর্ণ ভরা চারদিক। স্কুল-কলেজ নেই। হাড্ডিসার শিশুরা সাগরের কিনারে দল বেঁধে ঝাপাঝাপি করে। ক্লান্ত হলে বাড়ি ফিরে যায়। জলে-ভেজা বুকের বেওনেটের মতো পাঁজড়গুলো সূর্যের আলোতে চিল্কায়। এই তাদের বিনোদন, এই তাদের দিনকাটানোর খেলা। তাদের বয়স অপেক্ষা করে সাগর বেলার জন্য। কবে তারা নৌকায় উঠবে আর উপার্জনের বৈঠা হাতে অতিক্রম করবে সাগরের ফেনিল তরঙ্গ।
সাগর মোহনায় দুই থেকে তিন হাজার জেলে ইলিশ ধরে, কিন্তু সবাই হতাশ। ১৫০টা ইলিশও যদি রাত-দিনে ধরা পড়ে তাহলেও লাভ নেই। ফলে জেলেদের ভরা মৌসুমে আগাম কষ্টের সাইরেন বেজে উঠেছে। কি করবে তারা? এ কাজই তাদের সম্বল। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। জলদস্যুও সমুদ্রের বড়ো একটা সঙ্কট। তারা রাতে ট্রলার চেপে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে বের হয়। জোর করে ছিনিয়ে নেয় জেলেদের জাল, টাকা, ট্রলারের মটর ইত্যাদি। আবার কখনও জেলেদের জলে ফেলে দিয়ে ট্রলার নিয়ে উধাও হয়ে যায় নিমেষে। এছাড়াও সমুদ্র উত্তাল থাকলে নৌ দুর্ঘটনা তো আছেই। সবই আছে। আছে এনজিওর কিস্তির টাকার খবরদারি, আছে ক্ষুধা- ভাতের টান। শুধু ইলিশ নেই। তবু ইলিশের জন্য তাকে নামতে হয় সাগরে,সাগর দোলায়, ভাসায়, ভাসে সন্তান-প্রিয়তম মানুষের মুখ। কিন্তু এসব জানা, সব দেখা সত্ত্বেও নামতে হয় ক্ষুধার সাগরে।
যেখানে গেলে লবণ জলে মায়ের মুখখানা ছাড়া আর কোনো আশ্রয় চোখের চতুষ্কোণে ভেসে ওঠে না।
সমুদ্র পাড়ের এসব ভাগ্যাহত মানুষেরা গণতন্ত্র বোঝে না। কিন্তু ভোট দেয়। না দিয়ে উপায় নেই। এলাকা যতই উপদ্রুত হোক নির্বাচনের আগে ওখানে গণতন্ত্র যায়। সাত-পাঁচ আশা দেখিয়ে ভোট নেয়। সহজ-সরল মানুষেরা সুন্দর মোড়কে আবৃত অদ্রলোকদের বিশ্বাস করে স্বপ্ন দেখে। নির্বাচনেরর পরেই সব মোহ ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট নিয়ে তারা আবার যুদ্ধে নামে। চলে তাদের প্রাত্যহিক জীবন। ভাঙা-গড়ার মধ্যে চলতে থাকা এসব মানুষেরা অবলম্বন করবে কাকে? কালুগাজীকে না শ্রেণীসংগ্রামকে? এ প্রশ্নের উত্তর যারা জানতে চান তারা শহর ছেড়ে চলুন ওইসব উপদ্রুত উপকূলে। জীবন যেখানে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর আরেক নাম।
দীপংকর গৌতম: সাংবাদিক, কবি, কথাসাহিত্যিক, গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০২১০ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৪