শ্রীমঙ্গল: দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ আপনাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত এখন। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে কেবলি ডাকছে।
ঈদের ছুটিতে চাইলে যে কেউ হারাতে পারেন এই সবুজ বন্যায়।

৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গ কিলোমিটারের এ জনপদটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। চা, লেবু, আনারস, পর্যটনস্থান, রাবার, ব্যবসাঞ্চল প্রভৃতির কারণে শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী। এখানে রয়েছে মণিপুরী, ত্রিপুরা, খাসিয়া প্রভৃতি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। চা বাগানের ভেতর ঠাঁয় দাড়িয়ে ছায়াবৃক্ষের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বারবার মিশে যেতে চায় মন। যে দৃশ্যপটগুলোতেই বারবার জুড়িয়ে যায় প্রাণ।
আপনার সময় স্বল্পতার কথা মাথায় রেখে বেড়ানোর জন্য বিশেষ ৫টি স্থান উল্লেখ করা হলো। ঈদের ছুটি কাটাতে আপনি ইচ্ছে করলে দুই-এক দিন শ্রীমঙ্গল অবস্থান করে এই বিশেষ ৫টি স্থানের নিসর্গশোভা উপভোগ করতে পারবেন। ভ্রমণপ্রিয়দের কাছে এই বর্ষা মৌসুম শ্রীমঙ্গলের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করা শ্রেষ্ঠ সময়।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই চিরহরিৎ বন। বাংলাদেশের ৭টি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এটি অন্যতম। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার ১২৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত এটি। এখানে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ২৪৬ প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের দেখা মেলে এখানে। রয়েছে চশমাপরা বানর, মুখপোড়া হনুমান, কালো কাঠবিড়াল, ধনেশ পাখি, হরিণ। ১৯৯৭ সালে এই বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এটি। উল্লুক দেখার জন্য একটি শ্রেষ্ঠ উদ্যান। পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে তিন, এক ও আধ ঘণ্টার তিনটি পায়ে হাঁটার বনোপথ। পাখির কলকাকলি, পোঁকা-মাকড়ের অদ্ভুদ এক ‘ঝি-ঝি’ শব্দ, বানর ও উল্লুকের চিৎকার-ছুটাছুটি আপনার ভ্রমণের বাড়তি অভিজ্ঞতা। প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষণাদের জন্য তীর্থস্থান এটি। তবে এখানে ভ্রমণের পূর্বে গভীর নিরবতায় বিচরণসহ নির্দেশনাবলী পালন করা উচিত।

বাইক্কা বিল:
হাইল হাওরের অভ্যন্তরে ১০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বাইক্কা বিল অবস্থিত। ২০০৩ সালের ১ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয় বাইক্কা বিলকে একটি স্থায়ী মৎস্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। আইড়, কই, মেনি, ফলি, চিতল, পাবদাসহ আরো বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রজাতির মাছ এখানে বংশবৃদ্ধি করে টিকে রয়েছে। এই বিল শুধু মাছের জন্যই নয়, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয়।

বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এই হাওরকে গুরুত্বপূর্ণ পাখি এলাকা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাইক্কা বিলেই বসে পরিযায়ী পাখিদের মিলন মেলা। পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, ধুপনিবক, রাঙাবক, দলপিপি, নেউপিপি, পানমুরগি, বেগুনি কালেম, কালোমাথা কাস্তেচড়া, গেওয়ালা বাটান, মেটে মাথা টিটি, বুনো হাঁস, বালি হাঁস, বেগুনি কালেম, পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন পালাসের কুড়া ঈগল প্রভৃতি বাইক্কা বিলের প্রধান আকর্ষণ। ডিঙ্গি নৌকায় চড়েও আপনি পাখিদের সৌন্দর্যের সাথে ভাগ বসাতে পারেন। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্তের স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন।

মাধবপুর লেক
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই হ্রদ। এটি যদিও কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত তবুও শ্রীমঙ্গল থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটক প্রকৃতির আপন পরশে লালিত এই স্থানকেও দেখতে ভুল করেন না। এখানে টিলার উপরে উঠে দেখতে পাবেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। যা আপনাকে মুহূর্তে সীমাহীন আনন্দের ভরিয়ে তুলবে। চিত্রশিল্পীর হাতে আকা ছবির মত লেকের এই মনোরম দৃশ্যটি উপভোগ করে নিজেকে আপনার সার্থক মনে হবে। এই লেকের জলে রয়েছে গোল গোল পাতা। তারই ফাকে ফাকে ফুটে আছে নীল শাপলা। নাম না জানা বুনো ফুলের মৃদু ঘ্রাণ মুখরিত করে রাখবে।

বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশন
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারে অবস্থিত। সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা নামেই অধিক পরিচিত। তবে এখন এর নাম হয়েছে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। এখানে রয়েছে সাদা বাঘ, মেছোমাঘ, সোনালী বাঘ, মায়াহরিণ, অজগর, উল্লুক, ভাল্লুক, বানর, লজ্জাবতী বানর, সজারু, সোনালি কচ্ছপ, মথুরা, বন মোরগ, তিতির, ময়না, খরগোশ, পাহাড়ি বক, লক্ষ্মীপেঁচাসহ আরো অন্যান্য প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণী।

মণিপুরীপাড়া:
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ২ কি.মি. পথ। কালিঘাট চা বাগানের রাস্তা ধরে এগুলোই পৌঁছে যাবেন সহজেই। মণিপুরীদের রয়েছে স্বতন্ত্র কৃষ্টি ও সভ্যতা। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ সমৃদ্ধ এক বৈশিষ্ট্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিতি হতে চাইলে আপনি ওই পাড়ায় ঘুরে আসতে পারেন। মণিপুরী নারীদের তাঁতে বোনা কাপড় খুবই টেকসই এবং নান্দনিক। দামও স্বাভাবিক। শাড়ি, বিছানার চাদর, থ্রিপিস, ব্যাগ প্রভৃতি রয়েছে।

কিভাবে আসবেন:
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল আসার জন্য বাস-ই নির্ভরযোগ্য ও আরামদায়ক। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন প্রভৃতিতে মাত্র ৪ ঘণ্টার শ্রীমঙ্গল আসা যায়। ভাড়া ৩৮০/- থেকে শুরু। এছাড়াও কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেনেও আসতে পারেন। পারাবত, কালনি, জয়ন্তিকা ও উপবন এক্সপ্রেস ভিন্ন সময়ে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল আসে। এগুলোর ভাড়া ২৫০/- (শোভন চেয়ার) থেকে শুরু।
কোথায় থাকবেন:
শ্রীমঙ্গল রয়েছে অনেক হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ। তবে মান ও নির্ভরযোগ্যতা বিবেচনায় ‘নিসর্গ ইকো কটেজ’ (বুকিং নম্বর : ০১৭১৫-০৪১২০৭), ‘গ্রিন ভিউ রেস্ট হাউজ’ (বুকিং নম্বর: ০১৭১৯-৮৯৬৭৮৮, ০৮৬২৬-৭১০৫০), ‘গ্রিন লিফ গেস্ট হাউজ’ (বুকিং নম্বর : ০১৭৬৫-০২২৯৮৪, ০৮৬২৬-৭২৯১৪) এই তিনটি অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ‘শ্রীমঙ্গল টুর গাইড অ্যাসোশিয়েসন’ এর সম্পাদক তাপস দাসের (সেল নম্বর ০১৭২৩-২৯২৯৯৪) সাথে।
**ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন সিলেটে
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৪