ইসরায়েলের সাম্প্রতিক নজিরবিহীন হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংস করা। হামলায় নাতানজ, ইসফাহান ও ফরদোর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনা এবং একাধিক শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে নিশানা করা হয়।
স্যাটেলাইট চিত্র ও বিশ্লেষকদের মতে, অন্তত দুটি স্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। তবে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর অনেক অংশ গভীর ভূগর্ভে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ পরিমাণ এখনো পরিষ্কার নয়। ইসরায়েল দাবি করেছে, হামলায় ‘গুরুতর ক্ষতি’ হয়েছে, অন্যদিকে ইরান তা অস্বীকার করেছে।
আন্তর্জাতিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ইরানের প্রকল্প পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন, ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির জটিল প্রক্রিয়ার পুরো চেইনই ব্যাহত হয়েছে। তবে ইরান এই চেইন কয়েক মাসের মধ্যেই আবার গড়ে তুলতে পারবে, কারণ তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও উপকরণ রয়েছে।
তিনি সতর্ক করেন, শুধু বিমান হামলা দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
নাতানজ
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলায় ইরানের নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। হামলাটি শুধু উপরিভাগেই নয়, বরং গভীর স্তরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে—যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য সেন্ট্রিফিউজগুলো স্থাপন করা ছিল।
ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি আঘাত না এলেও, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে সেখানকার স্পর্শকাতর যন্ত্রপাতির (সেন্ট্রিফিউজ) মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্যাটেলাইট ছবিতে অন্তত দুটি ভবনে গুরুতর ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ মিলেছে।
নাতাঞ্জে ছয়টি উপরিভাগীয় ভবন ও তিনটি ভূগর্ভস্থ ভবন রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে দুটিতে ৫০,০০০ সেন্ট্রিফিউজ রাখার সক্ষমতা রয়েছে।
বাহ্যিকভাবে কোনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়নি, তবে নাতাঞ্জের অভ্যন্তরে তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক দূষণ হয়েছে। তবে আইএইএ বলেছে, তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য মাত্রার মধ্যে রয়েছে।
নাতানজের একটি ভবনে ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত রয়েছে, যা এখনো অক্ষত আছে। তবে সেটিতে হামলা হলে তা ‘ডার্টি নিউক্লিয়ার বোম’ বা তেজষ্ক্রিয় বোমায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকে— যা ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় ও পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইসফাহান
ইরানের ইসফাহান পরমাণু স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলায় ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়—কারণ ইসরায়েল ও ইরান উভয় পক্ষ থেকেই ভিন্নমত উঠে এসেছে। তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নিশ্চিত করেছে যে, ওই স্থাপনায় চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি দাবি করেন, ইসফাহানে ইরানের সবচেয়ে বড় পরমাণু গবেষণা কমপ্লেক্স, সেখানে শুধুমাত্র একটি শেডে আগুন লেগেছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি সীমিত।
কিন্তু ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি গুরুতর।
স্যাটেলাইট ছবিতে ইসফাহান কমপ্লেক্সের অন্তত তিনটি ভবনে দৃশ্যমান ক্ষতি দেখা গেছে। চতুর্থ ভবনের ক্ষয়ক্ষতি ছবিতে তাৎক্ষণিকভাবে ধরা না পড়লেও আএইএ জানিয়েছে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত।
কামালভান্দি দাবি করেছেন, ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কায় নাতানজ ও ইসফাহান—দুই জায়গা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আগে থেকেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যদিও সিএনএন এটি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
এনটিআই (নিউক্লিয়ার থেট ইনিশিয়েটিভ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালে চীনের সহায়তায় নির্মিত এই স্থাপনাটি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এখানে প্রায় ৩,০০০ বিজ্ঞানী কাজ করেন।
এখানে তিনটি ছোট চীনা গবেষণা চুল্লি, একটি ফুয়েল প্রোডাকশন প্লান্ট, একটি কনভার্সন ফ্যাসিলিটি, জিরকোনিয়াম ক্ল্যাডিং প্লান্টসহ আরও নানা ল্যাবরেটরি রয়েছে।
শনিবার ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা জানান, ইসফাহানে ইরান পারমাণবিক বোমা নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে—এ সংক্রান্ত ‘নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে তাদের হাতে।
তবে ইরান আবারও দাবি করেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না।
ফোর্দো
ইসরায়েল সম্প্রতি আঘাত হেনেছে ইরানের গভীর পাহাড়ের নিচে অবস্থিত ফোর্দো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টে, তবে স্থাপনাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মনে হচ্ছে।
ফোর্দো কুম শহরের কাছে একটি পাহাড়ের গভীরে নির্মিত এবং এখানে অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নিশ্চিত করেছে যে, এই স্থাপনায় কোনও ক্ষতি হয়নি এবং ইসরায়েলও কোনো বড় ধরনের ক্ষতির দাবি করেনি।
স্যাটেলাইট চিত্রগুলোও এই দাবিকে সমর্থন করে, যেগুলোতে কোনও দৃশ্যমান ক্ষতি দেখা যায়নি।
ইরানি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ওই স্থাপনের নিকটে একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে, যা হামলার চেষ্টা নির্দেশ করে।
বিশেষজ্ঞ আলি ভাইজ, বলেন এই জায়গায় আঘাত হানতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বাংকার-বাষ্টার বোমার প্রয়োজন হবে।
ফোর্দো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ২০২৩ সালে এখানে ৮৩.৭% শুদ্ধতার ইউরেনিয়াম পাওয়া গিয়েছিল, যা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্রায় প্রয়োজনীয় ৯০% শুদ্ধতার কাছাকাছি।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, যদি ফোর্দো সচল থাকে, তাহলে ইসরায়েলের আক্রমণ ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির পথকে মাত্র সামান্যই বিলম্বিত করতে পারবে।
অন্যান্য
যদিও ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা আক্রমণ করা, তবে তাদের হামলা ইরানের অন্যান্য সামরিক ও ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) সংক্রান্ত কয়েকটি স্থাপনাকেও আঘাত হেনেছে।
আরাক পারমাণবিক স্থাপনাটি, যেখানে একটি হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর রয়েছে , প্রথম হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মনে হচ্ছে। ওয়াটার রিঅ্যাক্টর প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এই কারণে পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বিগ্ন।
ইরাকের সীমানার কাছে পশ্চিম ইরানের পিরানশাহরে ইসরায়েলের হামলায় একটি ছোট সামরিক ভবন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, যা সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে।
তেহরানের পশ্চিম অংশে আইআরজিসি’র একটি বড় ভবন উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ছাদের বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে।
সূত্র: সিএনএন
এমএম